ডিসলেক্সিয়া
আশেপাশে অনেক শিশুর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার কোন কমতি না থাকলেও পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। যেমন, নতুন শব্দ পড়তে, লিখতে কিংবা মনে রাখতে সমস্যা। এই ধরনের সমস্যা দেখলেই আমরা ভেবে নেই এই শিশুর পড়াশোনার ইচ্ছা কম বা এই শিশুকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না। এক কথায় শিশুকে ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থী বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু এইটা অনেক ক্ষেত্রে শিশুর ইচ্ছাকৃত হেলামী নয়, শিশুটি এক ধরনের রোগে আক্রান্ত। এক ধরনের মানসিক রোগ, “ডিসলেক্সিয়া”।
ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। ‘dys’ অর্থ অপর্যাপ্ত আর ‘Lexix’ অর্থ শব্দ কিংবা ভাষা। যার মানে দাড়ায় অপর্যাপ্ত শব্দ কিংবা ভাষা। মানে শব্দ শনাক্তকরণে সমস্যা। জার্মান চক্ষু চিকিৎসক রুডলফ বার্লিন সর্বপ্রথম ডিসলেক্সিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন। মূলত বিভিন্ন শব্দকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারাকে তিনি ডিসলেক্সিয়া বলে চিহ্নিত করেন।
একটি শিশু ডিসলেক্সিয়াতে আক্রান্ত কি না তা একদম ছোটকালেই ধরা যায়, এমনকি শিশু স্কুলে যাওয়ার আগেই। যখন শিশু কোন শব্দ শুনে মনে রাখার চেষ্টা করে কিংবা শব্দকে শনাক্ত করতে চায়, তখন এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
- ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশু একইরকম দেখতে বা শুনতে অক্ষর বা সংখ্যাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। যেমন (b, d), (m, w), (6,9)
- নতুন কোনো শব্দের বানান বা অর্থ সে মনে রাখতে পারে না
- তথ্য বা সংখ্যা মনে রাখতে না পারা
- বাজে হাতের লেখা, পেনসিল ধরতে সমস্যা
- ঠিকমত বানান না লেখা
- কথাব গিয়ে শব্দ মনে না করতে পারা
- নির্দেশনানুযায়ী কাজ করতে না পারা
- নতুন ভাষা শিখতে সমস্যা
এ রোগের কারণ এখনও পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। তবে গবেষণা চলছে। শিশুদের প্রাথমিক জীবনেই এ রোগ ধরা পড়ে। তবে আপাতদৃষ্টিতে ধারণা করা হয়ে থাকে এ রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে বংশগতি সমস্যা। ইতোপূর্বে বংশের কেউ যদি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।
তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে রয়েছে জন্ম নেয়া শিশুর অপরিপক্কতা। শিশু যদি নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হয় কিংবা জন্মের পরে মস্তিস্কের যে অংশ কথা বলা এবং লেখাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ডিসলেক্সিয়া নির্ণয়ের কোনও নির্দিষ্ট উপায় নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত তথ্যাদি বিচার করে ডিসলেক্সিয়া বা অন্যান্য কোনও সমস্যা আছে কি না দেখেনঃ
- পারিবারিক মেডিকাল ইতিহাস
- লেখা পড়ার ক্ষমতা
- দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি
- পড়াশুনার অগ্রগতি
তবে এই রোগ প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে হওয়ার প্রবণতা তেমন নেই। যারা শিশু বয়স থেকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরেও তেমন চিকিৎসা বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই বড় হয় তাদের মধ্যে পরবর্তী জীবনেও এই রোগ বহন করার প্রবণতা থাকে।
চিকিৎসাঃ
শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞেরা মিলে শিশুকে বিকল্প উপায়ে শিখতে সাহায্য করেন। উদাহরণস্বরূপ, শিশুকে ক্লাসের পরা অডিও রেকর্ড করে শোনানো হয়। ত্রিমাত্রিক অক্ষর ছুঁয়ে ও স্পর্শ করিয়ে অক্ষর চেনানো হয় অথবা ছবি দেখিয়ে নতুন শব্দ শেখানো হয়। একজন ফোনেটিক্স বিশেষজ্ঞ তাকে পড়তে শেখান এবং উচ্চারণে সাহায্য করেন। এই ধরনের শিশুদের একটি বিশেষ পরিকল্পনা মাফিক ছোট ছোট লক্ষ তৈরি করে পড়তে উৎসাহ দেওয়া হয়। তবে ডিসলেক্সিয়াতে আক্রান্ত হলে এডিএইচডি হবার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় উল্টোটাও হয়। এডিএইচডিতে আক্রান্ত হলে ডিসলেক্সিয়ার চিকিৎসা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ডিসলেক্সিয়ার শিশুরা চূড়ান্ত প্রতিভার অধিকারী এবং সৃষ্টিশীল হয়। পর্যাপ্ত উৎসাহ ও সাহায্য পেলে তারা নিজেদের প্রতিভার ক্ষেত্রে শিখরে পৌঁছতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে এই রোগকে কঠিন কিংবা অপরিচিত মনে হলেও রোগ সম্পর্কে আপনার পরিষ্কার ধারণা থাকলে আপনি শিশুর যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এতে করে আপনার সন্তান একটি সুস্থ সুন্দর জীবন পাবে।
যেমনঃ ডিসলেক্সিয়ার কোনও উপসর্গ দেখলে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন, আপনার শিশুকে চিকিৎসকের কথা মত চলতে উৎসাহ দিন, জোরে জোরে গল্প পড়ে শোনান। রেডিওতে গল্প শুনতে উৎসাহিত করুন। আর একটু বড় হলে একসঙ্গে খবরের কাগজ ও গল্পের বই পড়ুন। মনে রাখবেন, বড়দের দেখেই ছোটরা শেখে। দেখুন তার কী করতে ভাল লাগে, সেই ক্ষেত্রে উৎসাহ দিন।
এছাড়া শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলুন এবং তাকে চিকিৎসকের সঙ্গেও দেখা করান। সেক্ষেত্রে তার আপনার বাচ্চাকে পড়াতে সুবিধা হবে। একজন অভিভাবক হিসেবে সন্তানের পাশে দাঁড়ান। সে যা করতে পারে তাতে উৎসাহ দিন, যা পারে না তাই নিয়ে জোর করবেন না।
মনে রাখবেন, এই রোগে আক্রান্ত শিশু ঠিকভাবে বেড়ে না উঠলে তা পরবর্তী জীবনের জন্য হুমকির কারণ। শিশুর পড়াশোনা, শরীর, স্বাস্থ্য, সুস্থভাবে বেড়ে উঠা এমনকি তার ক্যারিয়ারের জন্যও অনেক বিপদজনক।
ডিসলেক্সিয়া কোনো অনিরাময়যোগ্য রোগ নয়। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বাবা-মা, শিক্ষক ও আশেপাশের মানুষের একটু সহমর্মিতা, উৎসাহ ও সহযোগিতা পেলেই ডিসলেক্সিক শিশুরা এই ভয়াল রোগের কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে জীবন গড়ে তুলতে পারবে।