কাদম্বিনী গাঙ্গুলি
ছাত্রজীবনে যারা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা করে তাদের বেশিরভাগের মনে একবার হলেও ইচ্ছে জাগে ডাক্তার হওয়ার। এই ইচ্ছেটা বেশি থাকে বাবা-মায়ের মধ্যে। আর যদি একজন মেধাবী মেয়ের বাবা-মা হয়ে থাকে কেউ, তাদের অন্যতম ইচ্ছে থাকে তার মেয়ে যেন ডাক্তারই হয়। যে কারণে আমরা সব দেশেই বিশেষ করে উপমহাদেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের একটু বেশিই ডাক্তারি বিদ্যা নিতে দেখি।
তবে অনেকদিন আগের কথা যদি চিন্তা করি কিংবা যদি ব্রিটিশ শাসনকালের কথাই ধরি, যেখানে মেয়েরা স্কুল কলেজেই পড়ালেখা করতে পারত না, সেখানে তারা নিশ্চয়ই ডাক্তার কথা ভাবতেনও না। তখনকার দিনে মেয়েদের পড়ালেখার কথা কল্পনাও করা যেত না। বয়স ১০ পার হতেই বিয়ে না হলে যেখানে মেয়েদের মুখ দেখা পাপ ছিল, বিয়ের পর শুধু ছেলে সন্তানের মা হওয়ার মন্ত্রণা মেয়েদের দেয়া হতো, যেখানে স্বামীর চিতায় মেয়েদের জীবন্ত আগুনে পুড়ে ফেলার মত অমানবিক কাজ করা হয়েছিল- সেই সময়ে মেয়েদের মধ্যে কেউ ডাক্তার হবে এমনটা ভাবাও ছিল “ঘোর অমঙ্গল”। গেল গেল রব ওঠার মতো এক অবস্থা।
কিন্তু কড়া নিয়ম যেখানে আছে, নিয়ম ভাঙার উদাহরণও সেখানেই আছে যুগ যুগ ধরে। নিয়ম ভাঙা হয়েছিল বলেই আমরা আজকের এই উন্নত সমাজকে দেখতে পাই। মেয়েদের ঘরবন্দি জীবন থেকেও কেউ কেউ বের হয়ে এসেছিলেন, “ফ্লোরেন্স নাইটএঙ্গেল” হয়ে সমাজে উন্নতির আলো হয়েছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, “কাদম্বিনী গাঙ্গুলি”। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বাঙালি প্র্যাকটিসিং নারী ডাক্তার।
আজকের গল্প তাকে নিয়ে।
উনবিংশ শতাব্দীতে চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়া নারীদের জন্য ছিল দুঃসাধ্য। সেই শতাব্দীর মেয়ে হয়ে চলমান প্রথা ভাঙেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নারী চিকিৎসক। সাফল্যের পথটা মসৃণ ছিল না তার, ছিল কাঁটায় ভরা। রক্তচক্ষু দেখিয়েছে তৎকালীন সমাজ। তা উপেক্ষা করে অনেকটা পথ একাই হেঁটেছেন কাদম্বিনী।
চিকিৎসক হয়েও কাদম্বিনীকে সইতে হয়েছে শত অবহেলা। সমাজের মানুষের ধারণা ছিল, একটা মেয়ে কীভাবে ডাক্তার হয়? নেতিবাচক ধারণা ভেঙে বারবার আঙুল তোলা মানুষগুলোর মন জয় করেছেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।
একটা গল্প আছে- বড় বাড়ির সবার আদরের মেয়ে অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার আনতে ছুটল গাড়ি। গাড়ি থেকে যখন কাদম্বিনী নামলেন, বাড়ির সবাই বলে উঠল, ‘ওমা, ডাক্তার কই? এ তো মেয়ে!’
তার মানে ডাক্তার শব্দের সাথে জুড়ে ছিল একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ, পুরুষ লিঙ্গ। শুধু তাই নয় পুরুষ হলেও হবে না। হতে হবে দেশি পুরুষ। কেননা উপমহাদেশে তখন ইংরেজদের রাজত্ব ছিল। আর শিক্ষা বিজ্ঞান কিংবা চিকিৎসায় ইংরেজরা আমাদের দেশের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল। সেই সময়ে গোটা বাংলা আছন্ন হয়ে ছিল কুসংস্কারে, যার আঁচ সবচেয়ে বেশি ছিল মেয়েদের জীবনে। তারা রোগে প্রাণ হারাবেন কিন্তু কোন সাহেব (ইংরেজ) ডাক্তারের হাতে চিকিৎসা নেবেন না। এমনই ছিল তাদের পণ।
এমনিতে দেশি ডাক্তারদের হাতে চিকিৎসা নিলেও সন্তান জন্ম দেয়ার সময় আঁতুড় ঘরে ঢুকতে পারবে না কোন ছেলে। সেখানে দাই মা ছিল একমাত্র ভরসা। যার ফলে এই কুসংস্কারেই মারা যেত অনেক মেয়ে। ছোট থেকে এইসব দেখে দেখেই ছোট বীণী (কাদম্বেনি) মনে মনে পণ করে নেন যেভাবেই হোক বড় হয়ে ডাক্তার হবেন, নারী ডাক্তার।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ১৮ জুলাই ১৮৬১ সালে বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ব্রজকিশোর বসু। কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর জাতীয়তা ব্রিটিশ ভারতীয়। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ২ জন নারী স্নাতকের একজন ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রী অর্জন করেন এবং আনন্দীবাই যোশীর সঙ্গে তিনিও হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথম দিককার একজন নারী চিকিৎসক।
প্রতিটি পুরুষের সাফল্যে যেমন মেয়েদের অবদান থাকে তেমনি মেয়েদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় অনেক ছেলের অবদান। স্বামীর সাহায্যে বেগম রোকেয়ার নারী শিক্ষার পথিকৃত হয়ে উঠার গল্প তো আমরা সবাই জানি। প্রথম নারী ডাক্তারের জীবনটাও অনেকটা এমনই ছিল। তার জীবনের অসাধ্য সাধনের গল্পে অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন তার স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
নিজের একান্ত ইচ্ছা সঙ্গে স্বামীর ভালবাসা আর সহযোগিতাকে পুঁজি করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন কাদম্বিনী। একদিকে খুব সাহসী আর তেজস্বিনী অন্যদিকে ভারী আমুদে মানুষ, মাতৃভাষার মত অনর্গল ইংরেজি বলতে পারতেন। তখনকার সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশনের শাড়ি, জামা, জুতো পরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতেন। একটুও সময় তিনি নষ্ট করতেন না। যখন যেখানে বসতেন হাসি গল্পে একেবারে মাতিয়ে তুলতেন।
১৮৮১ সালে এফএ এবং ১৮৮৩ সালে প্রথম ভারতীয় নারী হিসাবে বি.এ. পাস করেন। বস্তুত এফএ পাশ করার পরেই তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুরুষ অধ্যুষিত সে যুগে এক মেয়ের বীরদর্পে অনুপ্রবেশ এত সহজে ছিল না, আসতে থাকে বাধার পর বাধা। এরই মধ্যে ১৮৮৩ সালে তার বিবাহ হয়ে যায় বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও নারী প্রগতির এক স্তম্ভ দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসেই ১৮৮৪ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি নিয়ে ভর্ত্তি হন কাদম্বিনী। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে বিয়ের সময় থেকে সমাজের এক স্থবির অংশের সাথে শুরু হওয়া অসন্তোষ, কাদম্বিনীর বিবাহ পরবর্তী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অসহযোগিতার আকার নেয়। শুরু হয় সমাজের রক্ষণশীল অংশের সঙ্গে লড়াই, সেই লড়াইয়ে তিনি সর্বদা পাশে পেয়েছেন তার স্বামী দ্বারকানাথকে।
১৮৮৮ সালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে তিনি যোগ দেন লেডি ডাফরিন হাসপাতালে। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ডাক্তারির ভবিষ্যত। আর এর কিছুদিন পরেই তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও শুরু করেন। তৈরি হয় এক নতুন ইতিহাস, অনেক লড়াই করে ভারতের প্রথম নারী গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, তখন স্বীকৃত হলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক (প্র্যাকটিশনার) হিসেবে। এরপর দ্বারকানাথের উৎসাহে চেম্বার খুললেন বেনিয়াটোলা লেন ও সুকিয়া স্ট্রিটে। এবারেও পথটা এত সহজ ছিল না। একজন নারী সবার মুখে ঝামা ঘষে এত সহজে ডাক্তার হয়ে যাবেন তাই এবার বিরোধিতা শুরু হল প্রকাশ্যে। তাকে নিয়ে শুরু হল বিদ্রুপ ।
‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার দাপুটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল সমস্ত শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে ডা.কাদম্বিনীকে তুলনা করেন ‘স্বৈরিণী’ এমনকি ‘বারবণিতা’র সঙ্গেও। আর পাঁচজনের মতো ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী ছিলেন না কাদম্বিনী। অন্যদিকে দ্বারকানাথও ছিলেন নারী স্বাধীনতা ও নারী প্রগতির ক্ষেত্রে সে যুগে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। সুতরাং তাঁরা শুরু করলেন আইনি লড়াই ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার বিরুদ্ধে। সে লড়াইয়ে আইনি জয় হল তাঁদের। অতঃপর ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার সম্পাদকের ৬ মাস জেল এবং ১০০ টাকা জরিমানা ধার্য্য হল।
এরপর ১৮৯৩ সালে দ্বারকানাথের উৎসাহে বিলাতে ডাক্তারি পড়তে যান কাদম্বিনী এবং সেখান থেকে সিসি, এলআরএস, ওজিএফসি- এই তিনটি ডিগ্রী নিয়ে প্রথম ভারতীয় নারী ডাক্তার হিসাবে দেশে ফেরেন। বিলেত থেকে ত্রিরত্ন উপাধি লাভের দিনটি ছিল ১৮ জুলাই। রয়েল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সারজানস অফ গ্লাসগোর রেজিস্টার জন ডব্লিউ রবের মতে ডা. কাদম্বিনী গাঙ্গুলীই ছিলেন ত্রিরত্ন উপাধিধারী প্রথম নারী ডাক্তার। তাই এই বাঙালী নারীর লড়াইয়ের খবর দেশের সীমা ছাড়িয়েছে তখনই।
ডাক্তার হিসাবে তার খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নেপালের রাজমাতার চিকিৎসার জন্য তিনি নেপালে যান এবং তাকে সুস্থ করে তোলেন। দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর বিবাহিত জীবন ছিল পনেরো বছরের। যা অত্যন্ত সফল, সম মনোভাব ও পারস্পরিক সাহচর্যের ভিত্তিতে কেটেছিল। উনিশ শতকের বৈবাহিক সম্পর্কে যা একেবারেই সহজ ছিল না। ১৮৯৮ সালের ২৭শে জুন মৃত্যু হয় দ্বারকানাথের। শুরু হয় কাদম্বিনীর একা পথচলা। তবে সময় হেলায় অতিবাহিত করেননি এরপরও। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ অব্যাহত ছিল। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ব্যস্ত ছিলেন রোগীর চিকিৎসায়, অস্ত্রোপচারে ।
১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর দিনটি ছিল বুধবার। ৬২ বছর বয়স্কা কাদম্বিনী সকাল ৯টা অবধি কাঁথায় নকশা তুলেছেন, তারপর রোগী দেখেছেন। ফিরে এসে স্নান করে একটু অসুস্থবোধ করায় শুয়ে পড়েছিলেন। এরপরই শোনা যায় গোঁ গোঁ আওয়াজ। আর বেশি সময় নেননি তিনি– শেষ কথা বলেছিলেন, “উঃ, সব শেষ!”পাশ ফিরে খুব শান্তভাবেই স্থির হয়ে গেলেন।
সুখ দুঃখ, প্রিয় অপ্রিয় কে সাদরে বরণ করে, সব বাধা-বিপত্তিকে নির্ভীকভাবে জয় করে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন কর্মচঞ্চল জীবনে, যা তাঁর মৃত্যু অবধি ছিল অব্যাহত। আজীবন লড়ে গেছেন পুরুষ-প্রধান রক্ষণশীল সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আজ এতদিন পরেও তাঁর বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া, নিজের কৃতিত্বের উপযুক্ত অধিকার ও সামাজিক সম্মান আদায় করা একরকম দৃষ্টান্তস্বরুপ। তাই অনন্তের পথে গিয়েও তিনি বেঁচে রইলেন আধুনিক বাঙালী তথা ভারতীয় নারী সমাজের এক উজ্জ্বল প্রতিভূ হয়ে।
পোস্ট লেখার পরে পোস্টের সম্পর্কিত একটা থাম্বেইল অথবা ফিচার্ড ইমেজ এড করে সাবমিট করবেন। ধন্যবাদ।