রিনু জানালার ধারে বসে আছে।বাসায় কেউ নেই। রিনুর বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে,প্রতিদিন সকালে তাই তাদেরকে বেরিয়ে যেতে হয়। রিনুকে দেখাশোনা করার জন্য বাবা-মা অবশ্য একজন মেইডকে রেখে দিয়েছেন।অনন্য দিন তার সাথে গল্প করেই রিনুর সময় কেঁটে যায়।কিন্তু আজ কোন এক কারনে সেই মেইডকেও বাইরে যেতে হয়েছে।বাড়ি থেকে রিনুর বাবা-মা একসাথেই বের হন।প্রতিদিন যাওয়ার সময় রিনুকে তারা অনেক আদর করে যায়।রিনু ভাবিত চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
রিনু একা একা বসে আছে।তার বয়স এখন পাঁচ,এখনো স্কুলে ভরতি হয়নি,মা বলেছে আরেকটু বড় হলেই তাকে ভরতি করিয়ে দেবে।তবে সন্ধেবেলা বাবা অথবা মার কাছে রিনু তার প্রথম পাঠ অনুশীলন করে।
কিন্তু আজ কিভাবে সময় কাঁটবে তার?আজ বাসায় বাবা-মা নেই ,মেইড নেই।তালাবদ্ধ ঘরে সে একা বন্দি।টিভি দেখে যে সময় কাটাবে তারও উপায় নেই,কারন এই মুহুর্তে বাড়িতে ইলেকট্রিসিটিও বেপাত্তা।ওহ কিচ্ছু নেই,সব যেন
একদিনে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বাবা-মা অবশ্য রিনুর কাছে একটা মোবাইল রেখে গিয়েছেন কিন্তু এক জিনিস দেখতে দেখতে সেটাও এখন বিরক্তির বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তাই বর্তমানে মোবাইলটি জানলার ধারের তেপায়াটার উপর অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে।
রিনুর এখন কিচ্ছু ভালো লাগছে না।তার ছোটা মুখটা বিরক্তিতে ভরে ওঠে।যখন মানুষের কোনকিছু করার থাকে না,তখন কর্মহীন বসে থাকাটাই সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর।কিন্তু রিনুর এখন বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।জানলার বাইরে আজ কোন পশু-পাখিও দেখছে না রিনু।সবাই কি তাকে আরি করে চলে গেল,কেউ কি তাকে একমুহুর্তও সঙ্গ দিতে পারবে না।রিনুর চোখটা ছলছল করে ওঠে।এমন সময় রিনু শুনতে পেল,”কি অত ভাবছো রিনু”?
রিনু একমনে অপলক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল,এই কথা শুনেই সে চমকে উঠল।সে পিছনফিরে তাকালো তারপর পরক্ষনেই মনে হল ডাকটা তো সামনের দিক থেকেই আসলো। সে জানলার বাইরে তাকালো কিন্তু বাইরে তো কেউ নেই।অথচ ও স্পষ্ট শুনেছে যে কেউ ওর নাম ধরে জিজ্ঞেস করেছে ও কি ভাবছে।ও এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।হঠাৎ করে আবার সেই কন্ঠস্বর,”কি হলো,কথা বলছো না যে”। এইসময় অন্যকেউ হলে এই অদৃশ্যবানী শুনে নির্ঘাত ভয় পেত কিন্তু রিনু পেল না।ও বেশ স্বাভাবিক স্বরেই বলল,”কে আপনি,কোথায় দাড়িয়ে কথা বলছেন”।
এবার অলক্ষ্য কন্ঠস্বরে হালকা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল।গায়েবী আওয়াজ বলল,”আমি তো তোমার সামনেই আছি”।
রিনু সামনে ভালো করে তাকালো,কয়েকটি আম,কাঠাল, আমলকির গাছ সামান্য দূড়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে এছারা বাড়ির মেইন গেট আর ছোট্ট পিচ বাঁধানো রাস্তা ছারা তার চোখে আর কিছুই পড়ছে না।ও হ্যা জানালার একটু সামনে একটা ছোট্ট লেবু গাছও তার দৃষ্টিগোচর হল।রিনু এবার মুখ খুলল,বেশ অভিমানের সুরেই বলল,”কই আপনি,আমার সামনে তো কেউ নেই”।
অলক্ষ্যমান কন্ঠস্বর বলল,”কেন গাছ দেখতে পাচ্ছ না”।
রিনু এবার একটু ভাবনায় পড়ল,গাছ কি করে কথা বলতে পারে!কেউ কি তার সাথে ঠাট্টা করছে?রিনু এবার বেশ আগ্রহ ভরা স্বরে বলল,”আমার সামনে তো অনেক গাছ,আমি বুঝব কি করে আপনি কোন গাছ”।
বাতাসে একটা হাসির আওয়াজ ভেসে এল।সেই কন্ঠস্বর হাসিমাখানো সুরে বলল,আমি হলাম গিয়ে তোমার সামনের এই লেবুগাছ”।
রিনু এবার বেশ অবাক হল,বিস্ময় সুরে বলল,”লেবুগাছ কথা বলে!”
এবার সেই অদূশ্যকন্ঠস্বর বলল,”কেন বলব না,তোমরা মানুষরা যেভাবে একে অপরের সাথে কথা বল,আমরাও সকল গাছেরা তেমনি একে অপরের সাথে ভাব বিনিময় করি।তবে তোমাদের মত করে নয়,আমাদের পদ্ধতিটা একটু আলাদা”।
রিনু কথাটা শুনে বেশ মজা পেল বলল,”সব গাছ কথা বলে?”তথাকথিক লেবুগাছ বলল,”সবগাছ কথা বলে। গাছেদেরও একটা সমাজ ব্যবস্থা আছে।নগর,গ্রাম আছে,এইযে আশেপাশের যত গাছ দেখছো,সবাই কথা বলছে”।রিনু বলল,
“সবাই কথা বলছে!তবে তাদের কথা আমি শুনতে পারছি না কেন”?লেবুগাছ বলল,”তারা চাচ্ছে না যে তুমি তাদের কথা শুনতে পাও,আমি চাচ্ছি তাই শুনতে পাচ্ছ তবে আরগাছগুলো কিন্তু তোমার কথা শুনতে পাচ্ছে”।
রিনু কিছু বলে না,চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।ওপাশ থেকেও কোন শব্দ ভেসে আসেনা।কিছুক্ষনপর রিনুই কথা বলা ওঠে।জানালা দিয়ে সামনের দিকে একটুখানি ঝুকে লেবুগাছটিকে ভালো করে দেখে বলে,”বাবা আর মামুনিও কি আপনার কথা বুঝতে পারবে”পরে আবার বলে,”মানে আপনি যদি চান।”
ওপাশ থেকে লেবুগাছ বলে,”না,আমি চাইলেও তারা আমার কথা বুঝতে পারবে না।”রিনু বেশ অবাককরা কন্ঠেবলে,”কেন?কেন? আপনি চাইলেও তারা শুনতে পাবেনা কেন”?ওপার থেকে হাস্যকন্ঠ ভেসে আসে,”যারা ভালোমানুষ শুধুমাত্র তারাই গাছেদের কথা বুঝতে পারে।”
রিনু বিস্ময়ের সুরে বলে,”আমি কি ভালো মানুষ!”
ওপার থেকে লেবুগাছ বলল,”যেহেতু তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ,ধরতে হবে তুমি ভালো মানুষ।”লেবুগাছের কথাশুনে রিনু মনে মনে আনন্দিত হল। সে লেবুগাছকে খুশিমনে জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা মামনি আর বাবা তাহলে আপনার কথা বুঝতে পারবেনা কেন?তাঁরা কি খারাপ”।
লেবুগাছটি গম্ভীরভাবে জবাব দিল,”একেবারে খারাপ নয়,তবে মাঝে মাঝে ওনারা একটু আধটু মিথ্যা কথা বলেন।গাছেদের কথা বুঝতে হলে একেবারে তোমার মত নিষ্পাপ হতে হবে”।মা-বাবা একটু খারাপ শুনে রিনুর মনটা হালকা খারাপ হয়ে যায়।রিনুর এই অবস্থা দেখে লেবুগাছ বলল,”মন খারাপ করলে নাকি।”
রিনু নিজেকে সামলে বলল,”কই না তো”।
এমন সময় প্রকৃতির মাঝ দিয়ে সামান্য বাতাস বয়ে গেল।সেই বাতাসের তালে তালে লেবুগাছ সামান্য দুলল।সেদিন রিনু সারাদিনই লেবুগাছের সাথে কথা বলে কাঁটালো।এমনকি রিনুর দুপুরে খাওয়ার জন্য টেবিলে যে খাবার রাখা ছিল তা খেতেও ভুলে গেল।সন্ধার রিনুর বাবা মা বাড়ি ফিরলে দেখল যে রিনু ঘুমিয়ে পড়েছে,তারা আর তাকে জাগালো না।টেবিলে না খাওয়া খাবার দেখে রিনুর মা অবশ্য মেয়ের প্রতি খুব রাগ করল কিন্তু ঘুমন্ত রিনুকে জাগিয়ে তাকে আর বকাবকি করল না।
পরদিন সকাল বেলা খুব ভোরে রিনুর ঘুম ভাঙলো।বাবা মা তখনো ঘুমোচ্ছে।বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে অগোছালো মুখে সে ঐ জানালার কাছে গেল,গিয়ে জানালা খুলে সে লেবুগাছটিকে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো।কিছুক্ষন বাদেই লেবুগাছ সারা দিল।
বলল,”কি?কেমন আছো?”
রিনু তার কথার উত্তর দিল।কুশল বিনিময়ের পড়ে রিনু বলল,”আচ্ছা,আপনি কিভাবে কথা বলেন?আপনার তো মুখ নেই।”
একটা হাসির আওয়াজ ভেসে এল,তারপর গম্ভীর স্বরে লেবুগাছ বলল,”কথা বলার জন্য কি মুখই সব?”কিছুক্ষন থেমে লেবুগাছ আবার বলল,”আমরা কথা বলি মন দিয়ে,জেনে রেখো মন দিয়ে যে কথা বলা হয় তা সবসময় সত্যি হয়,মুখ দিয়ে কিন্তু মিথ্যেও বের হয়। তোমাদের মানুষের ক্ষেত্রেও তাই,মানুষের হৃদয় অভন্তরে যে কথা থাকে তা কিন্তু সবসময়ই সত্যি,মানুষের হৃদয়ের কথায় যদি তিক্ততা থাকে তা ঢাকার জন্য মুখ সেই মনের কথা বিকৃত করে প্রকাশ করে।”
লেবুগাছের এই দীর্ঘবক্তিতার পর রিনু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল,এর ভিতরেই ওর বাবার গলা শোনা গেল,”কি রিনু?এত সকালে জানলা খুলে বসে আছো কেন?ঠান্ডা লাগবে তো,জানলা লাগিয়ে দেও”।
রিনু আমতা আমতা করে বলল,”এমনেই খুললাম,খুব সুন্দর দিন,তাইনা বাবা!রিনুর বাবা বলল,”চোখ মুখ ধুয়েছ”রিনু না সূচক মাথা নাড়াতেই বাবা বলল,”যাও চোখ মুখ ধুয়ে এসো,তারপর যা করার কর।”
রিনু আর কথা না বাড়িয়ে চোখ মুখ ধুতে গেল।
রিনুর বাবা-মা কিছুক্ষন আগে বাসা থেকে বেড়িয়েছে। মেইড আজকেও আসেনি।মেইড না আসাতে রিনু মনে মনে খুশিই হলো।বাবা-মা বেরিয়ে যেতেই রিনু জানালার কাছে গিয়ে লেবুগাছটিকে ডাকতে লাগলো।আশ্চর্য!অনেকক্ষন ডাকাডাকির পরও লেবুগাছ সারা দিচ্ছে না,কি ব্যাপার?সারা না পেয়ে রিনু অভিমানের সুরে বলল,কি হলো এখন সারা দিচ্ছেন না কেন।সারা দিন”। কোন উত্তর নেই।রিনু মন খারাপ করে ভিতরে চলে গেল।তার এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না,সব অসহ্য লাগছে।তবে গতকাল বা আজ ভোরে যা ঘটল তা সবই কি রিনুর মনের ভুল,না এ কি করে হতে পারে কনভারসেশন সবই তো স্পষ্ট ছিল তবে..
সেদিন রাতে ঘুমের ভিতর রিনু একটা স্বপ্ন দেখল,দেখল যে ও একটা বিশাল মাঠে দাড়িয়ে আছে।আশেপাশে কেউ নেই,হঠাৎ মনে হলো মাঠ নয়,ওদের বাড়ির সামনের আঙিনা।ওকে উদ্দেশ্য করে সেই লেবুগাছের কন্ঠস্বর বলছে,যা ঘটেছে তা সবই সত্যি,আজকে তোমার ডাকে সারা দিতে পারেনি বলে কিছু মনে করোনা,কি করে দেব বল,তুমি যেসময় আমাকে ডাকছিল তখন অনেক দূড়ের এক বাগানে এক গাছ কাঁটা হচ্ছিল,পৃথিবীর কোন প্রান্তে যখন কোন গাছ কাটা হয়,তখন আমাদের বড্ড ব্যাথা লাগে জানো।আমরা তো একই মাটির স্তনে লালিত ,তাই অন্য কোন জায়গায় যখন মাটি থেকে কোন গাছের শিকড় উপরে ফেলা হয়,সব গাছেরই তার আঁচর লাগে,আমরা তোমাদের মত না।আমাদের সকল গাছেরা একটি অদৃশ্য ভ্রাতৃত্ববন্ধনের সূতোয় বাধা,যা মানুষরা হাজার চেষ্টা করলেও আয়ত্ত্বাধীন করতে পারবে না।আমাদের চলন শক্তি না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের মনোজগৎ সর্বদা চলনশীল। যদি গাছেদের কথা আরো শুনতে চাও,তবে আরো গাছ আনো,আরো গাছ আনো,আরো আনো….
কথাগুলো কুয়াশার চাদরের মত মিলিয়ে গেল আর সেই সময়ই রিনুর ঘুম ভেঙে গেল।
সেই ঘটনার দুই বছর হয়ে গেছে।রিনুদের বাসার সামনের আঙিনাটুকু এখন গাছে পরিপূর্ন।অবশ্য অগোছালো ভাবে নয়,পরিপাটি করে সুন্দর সাজানো বাগান।সব গাছ রিনু নিজ হাতে লাগিয়েছে অবশ্য রিনু এতেই সন্তুষ্ট নয়,ও ঠিক করেছে ওদের এলাকার সব জায়গা ও গাছ লাগিয়ে ভরিয়ে দেবে।কিছু কিছু জায়গায় লাগিওছে।
না গাছেদের সাথে রিনুর আর কথা হইনি।তবে ও আশায় আছে,একদিন না একদিন এই বন্ধুরা ওর সাথে আবার কথা বলবেই।গাছেদের সাথে কথা না হলেও রিনু মাঝে মাঝে গাছেদের স্বপ্ন দেখে।তারা ওকে অভিবাদন জানায়।