মাতৃহারা পথশিশু
মঙ্গলবার,
০৯ তম ব্যাংকে চাকরির জন্য ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে হেটে জুড়িদার ঘরে ফিরছিলাম। বেশ কয়েক দিন যাবত ভার্সিটির কলা বাগানে বসে কিছুটা সময় কাটাতে মন বারোবার খুব অশান্ত হয়ে প্রতিবাদ করে উঠলো,সেদিন ঠিক করলাম পরীক্ষা তো তেমন মন্দ হয়নি তার হাতে যেহেতু অনেকটা সময় আছে তো একটু মনটা জুড়িয়ে আসি। আমি আমার মনের কিঞ্চিৎ দাবি পূরণ করতে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম কলাবাগানে। জায়গাটা এখন প্রায় জনশূন্যতা অথবা কাব্যন্তিক রচনায় লাভার্স পয়েন্টের রোমান্টিক ফুল ফোটানোর জায়গাটায় যেতে চায় না সহজে তবে শেষমেশ গন্তব্যে পৌছুলাম। মনটা শান্তির পানে একধাপ এগিয়ে।
চিরচেনা কংক্রিটের বেঞ্চে গুটিসুটি হয়ে বসে সন্ধ্যা অস্ত্র দেখার প্রস্তূতে আমি ব্যস্ত। অনেকদিন পর সন্ধ্যা অস্ত্র দেখার দৃশ্যটা অবলোকন করেছিলাম প্রবল সুখে হাতে-মন খারাপের চিরচেনা একটা ব্যানসন পুড়ছিল। হঠাৎ দেখি একটা ফুটফুটে বাচ্চা আমার পাশে কংক্রিটের বেঞ্চে এসে বসেছে। আমি কিঞ্চিত বিরক্ত তবে খানিকটা বিস্মিত! এত ফুটফুটে একটা শিশু, গায়ে একটা মলিন জরাজীর্ণ জামা। একটা লাল বাদামি দামী পোশাক পড়ালে বোঝা যাবেনা পাশে বসা ফুটফুটে মেয়েটি এক পথশিশু। যাহোক-সে আমার হাতে একটি চকলেট ধরিয়ে দিল , পকেট হতে মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিতেই বলে-
“ফাও ট্যাকা লই না! চকলেট নেন ট্যাকা দেন।”
আমার তো চোখ রীতিমতো অবিশ্বাস্য ছানাভড়া! বলে কী এই মেয়েটি! আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
নাম কি তোর?
এইবার বাচ্চাটা অন্যমনষ্ক আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! যেন আশ্চর্য কিছু শুনছে! তারপর ফট করে জবাব দিল-
“নাম নেইক্ক্যা। তবে লোকে আমারে খুনশুটি ডাকে। আপনে কি চকলেট নিবেন?”
মেয়েটার কথা শুনে কেমন জানি মোচড় দিয়ে কিড়মিড় করছিল মনটা। বললাম-
“পড়িস না কেন? এইখানে ফেরি করিস? পড়তে পারিস না?”
মেয়েটি এবার ঝনঝনে গলায় বলে-
“ট্যাকা কি আপনের বাপে আমারে দিবো?”
আমি এই মেয়ের কথায় পুরা উই়ং গাইরেসের ইনসুইংগার ও আউটসুইংগারের তোপে হাবুডুবু খাচ্ছি রীতিমতো! মেয়েটার দিকে আবারও একদম গভীর অবাকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম-
“বাবা-মা’কে বলবি তুই পড়তে চাস।”
“বাবা-মা! আমার বাবা জন্মের আগে থেকেই নেই, মা – ছিল! সেও গতকাল অজানা দূর দেশে চলে গেছে। এখন বস্তিতে একটা মাসি আছে হেই পালবে পুশবে আমায়।”
আমি মিনিট খানেক মতো অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম-“শিশুতোষ। যা বাবা মা না থাকার কারণে চরিত্রগুলো জীবন আরো মজার এবং দুঃসাহসীক হয়ে থাকে। অন্যরকম পারিবারিক বাধ্যবাধকতা এবং নিয়ন্ত্রণ বঞ্চিত হয়ে তারা নিরানন্দ জীবন অতিবাহিত করে। এটি চরিত্রগুলোকে আত্মনির্ভরশীল এবং অন্তর্মুখী করে তোলে আর তারা স্নেহের জন্য ক্ষুধার্ত থাকে। অনাথেরা সবসময় আত্মোপলব্ধি চেষ্টা করে যেন তারা তাদের শেখর খুঁজে পেতে পারে। পিতা- মাতা হলো শিশুদের সঙ্গী এবং সাহায্যের উৎস আর বাবা-মার
অনুপস্থিতি শিশুদের সমস্যা গুলো আরো প্রকট করে তোলে।
এবার আমার মত পাথর একটা মানুষের চোখেও মনে হয় বান ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। নিজেকে সামলে মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বললাম-
“পড়তে চাস?”
“হুম! চাই! কেলাস ওয়ান পর্যন্ত পড়ছি। ট্যাকা নাই পড়ার আবার মা’ই মরে গেল! ক্যেমনে পড়বো? তবে একটা বই কিননের খুব ইচ্ছা। কিনতে পারি না।”
আমার মন কেঁদে উঠলো। আমি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি নিষ্পলক। ধ্যান ভাঙলো। মানিব্যাগটা বেজায় ফাঁকা। তারপর হাত দিলাম দুইটা একশত টাকার নোট। বের করে মেয়েটির হাতে দিতেই মেয়েটা আবার প্রতিবাদ করে বলে –
“ফাও ট্যাকা নেই না! দিলে কিনা দেন।”
মনে হলো এক বোন তার ভাইয়ের কাছে দাবি করছে। আমি একটা ছোটদের ছড়ার বই কিনে দিতেই মেয়েটা কি খুশি! বিশ্বাস করেন-ওর খুশি দেখে নিজের জীবনে খুব বড় একটা শান্তি অনুভব করছিলাম। মেয়েটি বই হাতে নিয়ে দ্রুত সামনে থেকে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। আমার চোখের কোনে কয়েক বিন্দু মুক্তে চিকচিক করছে। সত্যি! এরকম কতহাজার মাতৃহারা পথশিশু একটু মমতা পেলে ঈদের চাইতেও বেশি খুশি হয় ।
লেখক – তানসেন