জাহানারা ইমাম
১৯৭১ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে এমন এক সময় ছিল, যখন চারদিক থেকে শুধু খারাপ খবরই ভেসে আসত। কোথাও কোন শান্তি ছিল না, যেখানে সেখানে ছিল শুধু লাশের স্তুপ, ব্যক্তিজীবনে ছিল স্বজন হারানোর শোক। এমন অনেকেই ছিলেন যে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা বেঁচে ছিলেন, দুঃসহ জীবন ভোগ করেছেন। আহা!! কি মর্মান্তিক সেই জীবন…একাত্তরের এমনি এক জীবনের গল্প বলবো আজ।
জাহানারা ইমাম, ১৯৭১ সালে শহীদ রুমীর আম্মা। ১৯২৯ সালের ৩ মে মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম জুড়ু। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম।
তিনি পরিচিতি লাভ করেন তার বড় পুত্র শহীদ রুমীর মধ্যে দিয়ে। ১৯৭১ সালের ঢাকায় “ক্র্যাকপ্লাটুন” নামের যেই টিম পাকিস্তানীদের নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল, সেই ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন জাহানারা পুত্র রুমী। আগস্ট মাসের ৩০ তারিখে এক দল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে রুমীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী, সেই দলে রুমী ছিলেন সর্বকণিষ্ঠ সদস্য। ঐদিনের পরে রুমী আর ফিরে আসেননি।
১৯৪২ সালে জাহানারা ইমাম ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে, বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। সেখান থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
ময়মনসিংহে বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালে তার বড় ছেলে যুদ্ধে অংশ নেয় এবং ছোট ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে, শুধুই কি তাই? বাদ যাননি জাহানারা ইমাম নিজেও, মুক্তিযোদ্ধাদের দরকারে তিনিও পাশে দাঁড়ালেন। তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, হয়েছিলেন সবার মা। তাদের দেখাশোনা করতেন বাড়ীতে আসলে, অর্থের যোগান দিতেন, ওষুধের যোগান দিতেন। তার স্বামী ছিলেন এই মহান কাজে। পরিবারের সবাই অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
এই জননীর প্রতিভাও কিছু কম ছিল না। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ গজকচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, বিদায় দে মা ঘুরে আসি; কী অপূর্ব! তাছাড়াও আছে বীরশ্রেষ্ঠ, অন্য জীবন, জীবন মৃত্যু। আর তার লেখা একাত্তরের দিনগুলো হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে জাহানারা ইমামের স্বামী মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, দেশপ্রেমিক শরীফ ইমামও ইন্তেকাল করেন। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শফি ইমাম রুমী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে নির্মমভাবে শহীদ হন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্রেই তিনি শহীদ জননীর মযার্দায় ভূষিত হন।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
এ সময় খুব দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে ২ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়েট হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।