মহান মে দিবস

”শিশিরের পুণ্য দেখিয়াছে কবি,রচিয়াছে কতো গান;
শ্রমের ঘর্ম তারচেয়েও স্নিগ্ধ, শুদ্ধ মহিয়ান!”
আজ মহান মে দিবস। শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের ঐতিহ্যে মহিমান্বিত আন্তর্জাতিক সংহতির দিন, ঐক্যের দিন,নতুন সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন । শপথ নেওয়ার দিন শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়কার কথা।১৭৮৯তে মহান ফরাসি বিপ্লব ভেঙেছিল দীর্ঘদিনের সামন্তবাদী সমাজের স্থবিরতা। সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্লোগান তুলে মানুষের চিন্তাকে উন্নত মানবিক স্তরে উন্নত করেছিল। সে কারণে লক্ষ-কোটি মানুষের সংগ্রামে সামন্ত স্বেচ্ছাচারী সমাজ ভেঙে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল; কিন্তু জনগণের মনে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শ্রম শোষণের তীব্রতা তো কমলই না বরং বহুগুণ বেড়ে গেল।শিল্পবিপ্লব উৎপাদন বৃদ্ধির নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে, গ্রাম থেকে লাখ লাখ কৃষক শিল্প-কারখানায় এসেছে, সৃষ্টি হয়েছে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের। একদিকে বেড়েছে উৎপাদন, অন্যদিকে বেড়েছে শ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ। একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার উৎপাদনের বহুমুখী বিকাশ ঘটিয়েছে।ফলে সমাজের সমৃদ্ধি, ধনীদের বিলাসিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বেড়েছে, বেড়েছে দারিদ্র্য। জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করা শুধু নয়, নারী ও শিশুদের কারখানায় পাঠাতে বাধ্য হতে লাগল শ্রমজীবী মানুষ। মালিকরা মুনাফা বাড়াতে শ্রমঘণ্টা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করত তা শ্রমিকদের জীবন একেবারে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।শ্রমিকরা তখন দিনে গড়ে ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করলেও তার বিনিময়ে সামান্য মজুরিও পেতেন না।ধনতন্ত্রের প্রধানতম ত্রুটির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে শিল্প মালিকরাই অধিক লাভ ভোগ করতো। উল্টোদিকে শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করতো। উপরন্তু ছিল মালিকপক্ষের অনবরত অকথ্য নির্যাতন। কখনো আবার তা পৌঁছাতো ক্রীতদাসতুল্য পর্যায়ে ।
সেসময়ে ইংল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজসংস্কারক রবার্ট ওয়েনের শ্রমিকদের জন্য আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা মনোরঞ্জন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রামের তত্ত্ব শ্রমিকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাঁদের মজুরি না কমিয়ে সারা দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তাঁরা একটি সংগঠনও তৈরি করেন পরবর্তীকালে, যার নাম হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়ন । এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের স্লোগান ছিল-
সেসময়ে ইংল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজসংস্কারক রবার্ট ওয়েনের শ্রমিকদের জন্য আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা মনোরঞ্জন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রামের তত্ত্ব শ্রমিকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাঁদের মজুরি না কমিয়ে সারা দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তাঁরা একটি সংগঠনও তৈরি করেন পরবর্তীকালে, যার নাম হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়ন । এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের স্লোগান ছিল-
“Eight hours for work, eight hours for rest, eight hours for what we will.”
শিল্পসমৃদ্ধ আমেরিকার শিকাগো শহরে ‘৮৬ এর এপ্রিলে এ আন্দোলন প্রবল গতি লাভ করে। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের বিষয়টিকে মাণদণ্ড হিসেবে বিবেচনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। বারবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও একটুও সাড়া মেলে না তাঁদের কাছে। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এ বিষয়ে এক আলোড়ন তোলা আর্টিকেল। ব্যস, বিদ্রোহ ওঠে চরমে। আর শিকাগো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-বিদ্রোহের মূল মঞ্চ।পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ অবধারিত হয়ে উঠছিল। মালিক-বণিক শ্রেণি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। পুলিশ আগেই শ্রমিকদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। আবারও চলল তেমনই প্রস্তুতি। শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে পুলিশকে বিশেষ অস্ত্র কিনে দেন ব্যবসায়ীরা। পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে নেমে আসেন রাস্তায়।দেওয়া হয় হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচী।আন্দোলন চরমে ওঠে।

৪ মে, ১৮৮৬ সাল। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চারিদিকে হালকা বৃষ্টির সাথে হিমেল হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন।অগাস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে মেথিয়াস জে. ডিগান নামের একজন পুলিশ তৎক্ষণাৎ এবং আরও ছয়জন পরবর্তীতে নিহত হয়। পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই দাঙ্গায় ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে অগাস্ট স্পীজ-সহ মোট আটজনকে প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ‘অস্কার নীবে’-কে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অবাক করা ব্যাপার হলো, ফাঁসি দেয়ার আগেই কারারুদ্ধ অবস্থায় ‘লুইস লিং’ নামের একজন আত্মহত্যা করেন। বাকি ছয়জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর তারিখে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেয়া হয়।
ক্ষমা প্রদর্শনের আবেদন জানাতে অস্বীকার করে এই সব বীর শ্রমিক নেতারা সৃষ্টি করেছিলেন আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও ইতিহাস। অগাষ্ট স্পাইস আদালতে বলেন,
ক্ষমা প্রদর্শনের আবেদন জানাতে অস্বীকার করে এই সব বীর শ্রমিক নেতারা সৃষ্টি করেছিলেন আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও ইতিহাস। অগাষ্ট স্পাইস আদালতে বলেন,
“ অভাব ও কষ্টে খেটে খাওয়া লক্ষ লক্ষ শোষিত মানুষের আন্দোলনে তাদের মুক্তির আশা দেখে আপনারা যদি ভাবেন যে, আমাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েই আপনারা সেই শ্রমিক আন্দোলনকে উচ্ছেদ করতে পারবেন, যদি এটাই আপনাদের মত হয়, তবে দিন আমাদের ফাঁসি। এখানে একটা স্ফুলিঙ্গের ওপর আপনারা পা দেবেন, কিন্তু সেখান থেকেই আপনাদের পেছনে, আপনাদের সামনে এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে লেলিহান অগ্নিশিখা। এটা ভূ-গর্ভের আগুন এবং আপনারা তা কখনও নেভাতে পারবেন না।”
ফাঁসিতে ঝুলার আগ মুহূর্তে শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পীজই দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন,
“The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.”

বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতিধারায় ১৮৮৯ সালে মহামতি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিক(ইন্টারন্যাসিওনালে)। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্যারিস কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় হে মার্কেটের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মরণে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে পালন করার।এঙ্গেলস ঘোষণা দেন,“শুধু ৮ ঘন্টা শ্রমদিবসের জন্য মে দিবসের সমাবেশ নয়, তাকে অবশ্যই সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্রেণী বৈষম্য ধ্বংস করার শ্রমিকশ্রেণীর দৃঢ় সংকল্প গ্রহণের সমাবেশ পরিণত করতে হবে।”এর ধারাবাহিকতায় পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। বর্তমানে বিশ্বের আশিটিরও বেশি দেশে মে দিবস মর্যাদার সাথে পালিত হয়।
১৮৮৬ থেকে ২০২০ সাল। এ বছর মে দিবসের রক্তাক্ত সংগ্রামের ১৩৪ বছর পালন করছে শ্রমিক শ্রেণী। কিন্তু ইতিহাস কি শুধু অতীতের কথা বলে? যে ইতিহাস বর্তমানকে প্রভাবিত করে, পরিচালিত করে ভবিষ্যতের দিকে, সেই ইতিহাস ই জীবন্ত।সে ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজকে, ব্যক্তির যুক্তিকে শানিত করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহস জোগায় এবং স্থবিরতা দূর করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় উন্নততর স্তরে। মে দিবসের ইতিহাস তেমনি এক গতিময় ও সংগ্রামের ইতিহাস।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রমজীবী মানুষের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলে চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান, কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাটা খেয়ে মরে। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’ আজও কি এই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে?পরিসংখ্যান বলে খুব একটা বদল ঘটেনি। বদল ঘটেছে প্রেক্ষাপটের। অনুন্নত দেশের বঞ্চনা থেকে উত্তরণ ঘটেছে আধা উন্নত অথবা উন্নত দেশের বঞ্চনায়। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির নানাবিধ সূচকে আমরা প্রভূত উন্নতি সাধন করেছি – মাথাপিছু আয়, জিডিপি আরো কতো কি! তবে অত্যন্ত পীড়াদায়কভাবে বেড়ে উঠেছে আয় বৈষম্য, ধনী-গরীব ব্যবধান,সামাজিক অসাম্যের মতো বিষয়গুলি। আয় বৈষম্য নিরূপণে অর্থনীতিতে একটি সূচক বা সহজ ব্যবহার করা হয়,যার নাম হলো “গিনি সূচক”(Gini’s Co-efficient)।এর মান ১ থেকে 0 পর্যন্ত হতে পারে। ১ হওয়ার অর্থ হলো প্রকট আয় বৈষম্য। আর শূন্য মানে হলো আয় বৈষম্য নেই। আমাদের স্কোর সেখানে প্রায় শূন্য দশমিক পাঁচ শূন্য!( হিসাব অনুযায়ী 0.46)।সূচকের মান দশমিক পাঁচ শূন্য অতিক্রম করাকে অশনি সংকেত বিবেচনা করা হয়।তাছাড়া দেশে অতি ধনীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বাড়ছে। হিসাব এও বলে দেশের বিপুল সম্পদ মাত্র ৫ শতাংশ অতি ধনীর হাতে কেন্দ্রীভূত। এ অবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে আমাদের এতো এতো সফলতার পর ও উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে আমাদের!আমরা আশা করবো তা যেনো কখোনোই না হয়,ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজের যে স্বপ্ন দীর্ঘকাল ধরে শোষিত সর্বহারা মানুষ দেখে আসছে-যে স্বপ্নপূরণে তারা আত্মত্যাগেও পিছ পা হয় নি – সেই আদর্শবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়া।এ প্রেরণাও আমরা পাই মহান মে দিবস থেকেই। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস আন্দোলনের নেতা অগাস্ট স্পাইস, এঙ্গেলস, ফিশার,পারসনস প্রমুখেরা জীবন দিয়ে আন্দোলনের যে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন তা আজও নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন সংকটে নতুনভাবে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকের অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে পথ দেখাবে । অতীতের শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণে মে দিবস চেতনা আজও তাই অফুরন্ত; অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।ইনকিলাব জিন্দাবাদ!