বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনকার যেই সময়টা, সেখানে প্রায়ই দেখা যায়, নানা ধরনের সন্ত্রাসী হামলা-জঙ্গি হামলা সংগঠিত হচ্ছে আর সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ সমাজ। বলা চলে বিপথগামী তরুণ সমাজ। কিন্তু এই দেশে ১৯৭১ সালেও এক ঝাঁক তরুণ ছিলো, তাদের নীতি আদর্শ কিংবা চেতনাবোধও ছিল আলাদা। তাদের তুলনা আসলে তারা নিজেরাই।
তেমনি এক সাহসী তরুণ ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধের ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাযোদ্ধা শহীদ বদিউল আলম বদি। ক্যাডেট নং– ১৬৪, বদিউল আলম বদি, ৭ম ব্যাচ, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ।
ক্যাডেট কলেজে পড়া বদি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগের মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স। সেই সাথে তার ছিল গল্পের বই পড়া প্রচন্ড নেশা। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার এই নেশাকে সাথে নিয়েই জীবনের সব পরিক্ষায় ভালো ফল অর্জন করেছিলেন।
মুক্তিসংগ্রাম শুরুর সাথে সাথেই দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলে তিনি ২৮ মার্চ তার নিজ এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিলো- সেখানকার ডাকাতদের সংগঠিত করে তাদের অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। ওই সময়ে গফরগাঁও থানা (যা শহীদ বদিউল আলমের নিজের বাড়ির এলাকা) ‘ডাকাতদের এলাকা’ বলে সাধারণ মানুষের মুখে কুখ্যাত ছিলো।
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে পান, কিন্তু যোগ দেননি। শুরুতে মা রওশন আরা খানম কিছুটা আপত্তি জানান। বাবা আবদুল বারী সাহেব মা রওশন আরাকে বললেন, ‘তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে।’ মা আর আপত্তি করেননি।
মেধাবী ছাত্র বদি অল্পদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন পাকিস্তান বাহিনীর আতঙ্ক। পাকি’দের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম ওঠে বদির। তাঁদের ঢাকার বাসাটি গোলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িও।
১৯৭১ সালে পুরো ঢাকাজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অপারেশন ছিল অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, ক্র্যাকপ্লাটুনের সদস্য সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায় ৭ই আগস্ট রাত ৮টায় এই অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পুরো অপারেশনের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল মাত্র এক মিনিট। এই দলের সদস্য ছিলেন ৭ জন- জুয়েল, আলম, পুলু, স্বপন, সামাদ আর বদি এবং দলনেতা ছিলেন শহীদ বদিউজ্জামান। তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক সামাদ চালাবেন গাড়ি, আলমের হাতে থাকবে চাইনিজ এলএমজি আর অন্য সবার হাতে স্টেনগান এবং সামাদের কাছে ছিল রিভলবার, জুয়েল আর পুলুর কাছে ছিল ফসফরাস গ্রেনেড আর গ্রেনেড-৩৬। এক মিনিটের এই অপারেশনে পাঁচজন মিলিটারি পুলিশ ও ছয়জন রাজাকার নিহত হয়।
মধ্য এপ্রিলে বদিউল আলম কিশোরগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি তারাইল থানার জাওয়ার গ্রামে দু’তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এ সময়েও অদম্য বদিউল ও বন্ধু হেলাল থেমে থাকেননি। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন এবং রাজাকারদের নিরস্ত্র করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল তারাইল থানা অপারেশন ও অস্ত্র লুট করা। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র শক্তি বাড়ে এবং তারা মানসিকভাবেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হন।
এরপরে তারা দুজনে ঢাকার উদ্দেশ্যে বদিউলের নানার বাড়ি পাকুন্দিয়ায় গেলে হেলালকে বদিউলের মা বলেন, ‘তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস এতে একদিন যেখানে সেখানে ঠিকানাবিহীনভাবে তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তোরা যা, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা কর। এভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার ছেলে যদি মারাও যায়, মা হিসেবে আমি গর্ববোধ করবো।’ এরপরে হেলাল ও বদিউল গফরগাঁও হয়ে ঢাকায় চলে আসেন।
গফরগাঁও পৌঁছার পর তারা শুনতে পান, ২য় ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে কিশোরগঞ্জ গিয়ে অবস্থান করছে। এ খবর শুনে তারাও কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানে ২য় ইস্ট-বেঙ্গলের কাছ থেকে চারজনের জন্য চারটি পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল, ৪০ রাউন্ড গুলি ও ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে পহেলা এপ্রিলেই তারা ঢাকার আর কে মিশন রোডে আশফাকুস সামাদের বাসায় এসে ওঠেন। পরে অস্ত্রগুলো তোষকে মুড়ে তাদের ছাত্রবন্ধু তওহিদ সামাদের (চালক) গাড়িতে করে ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে আরেক বন্ধু ওয়াসেফ-এর বাসায় নিয়ে যান এবং সবার অগোচরে ওই বাসার পেছনে মাটির নিচে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন।
২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন সাহেবের বাসায় তাঁর ছেলে ফরিদ (এনএসএফ কর্মী এবং এই ফরিদ’ই পাকি আর্মিদের কাছে বদিউল আলমের অবস্থানের কথা পাচার করেছিল), জাফর আহমেদ ও পারভেজ হাসানদের সাথে যথারীতি তাশ খেলছিলেন বদিউল। এখানে বন্ধুদের সাথে প্রায়শই তিনি তাশ খেলার আড্ডায় বসতেন। খেলার একপর্যায়ে জালালউদ্দিন সাহেবের ছেলে ফরিদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আর্মি নিয়ে প্রবেশ করে। পাক-বাহিনীর একটি দল করেই বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। পাক-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
.
বদিউল আলমের সহযোদ্ধা মনু বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাশাপাশি সেলে। ঘটনাচক্রে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। মনু জানান, সেনাদের নির্যাতনে বদির একটি হাতের জয়েন্ট খুলে যায় এবং হাড় ভেঙে ঝুলে গিয়েছিল। মনুরও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। বন্দি শিবি ভয়ংকর মার খেয়েও ঠাণ্ডা গলায় শহীদ বদিউল আলম বলেছিলেন, “আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। You Can Go to Hell” ।
আজ শহীদ বদিউল আলম বদির নিখোঁজ হওয়ার দিন। বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো এই মুক্তিযোদ্ধার এবং দেশপ্রেমের প্রতি।